১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
বিকাল ৫:১৯

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

বাংলাদেশের অদ্ভুত খাবার: মাটির বিস্কুট ‘ছিকর’ তৈরির রহস্য

পোড়ামাটির এ অদ্ভুত বিস্কুট তৈরি হতো হবিগঞ্জসহ সিলেটের কিছু অঞ্চলে। এছাড়া, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলেও এদের দেখা যেতো। আমি নিজেও দু’এক বার মুখে দিয়ে দেখেছি। মাটি দিয়ে তৈরি এই বিস্কুটের নাম ছিকর।

১৯৭০-১৯৯০ সালের দিকে ছিকর বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত ছিল। অনেকের মতে, ক্ষুধা নিবারণের জন্য নয়, অভ্যাসের বশেই লোকজন ছিকর খেতো। ছিকর ফারসি শব্দ। ছিয়া অর্থ কালো, কর মানে মাটি। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হিসেবে পরিচিতি পায়। এঁটেল মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা হতো এই বিস্কুট।

যেকোনো এঁটেল মাটি দিয়েই ছিকর তৈরি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন পাহাড়ি টিলার তলদেশের এঁটেল মাটি। ছিকর তৈরি করতে প্রথমে বিশাল গর্ত খুঁড়ে এর তলদেশ থেকে লম্বা বাঁশের সাহায্যে সংগ্রহ করা হয় এক ধরনের মিহি মাটি। এরপর সারা রাত ওই মিহি মাটি ভিজিয়ে নরম করে কয়েক ধাপে মাখিয়ে আরও মসৃণ করা হয়। অতঃপর ছাঁচে ফেলে প্রথমে মন্ড তৈরি করে তারপর কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়।

চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকৃতিতে কাটা হয় ছিকর। যেমন- লম্বা করে বা লজেন্স আকৃতির মতো। কাটার পর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দু-এক দিন শুকিয়ে এক ধরনের বিশেষ চুলায় পোড়ানো হয়। তারপর মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙে সেখানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি চালুনি বসিয়ে ছিকরগুলো তার ওপর বসানো হয়। হাঁড়িটি একটি মাটির গর্তে রেখে ধানের তুষ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয় গর্তে। সতর্কতার সঙ্গে ছিকরের গায়ে ধোঁয়া লাগানো হয়। দুই ঘণ্টা পর ছিকর কালচে রং ধারণ করে ও সুঘ্রাণ তৈরি হয়।

হবিগঞ্জে প্রথম ছিকর তৈরির প্রচলন হলেও পরে বিভিন্ন এলাকায় এর জনপ্রিয়তা বাড়ে। একেক এলাকার ছিকরের স্বাদে তখন ভিন্নতা ছিল। কোনো এলাকার ছিকরে খাই মাখানোর সময় গোলাপজল, আদার রসও মেশানো হতো। যা মাটির সঙ্গে পোড়ানোর পর অদ্ভূত সুন্দর এক স্বাদ পাওয়া যেতো। গর্ভবতী নারীদের কাছে ছিকর খু্ব পছন্দের খাবার ছিল। তারা বিশ্বাস করতো ছিকর খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর গন্ধটিও অদ্ভুত সুন্দর। পাহাড়ি এলাকার হিন্দু নারীরা এগুলো তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। আবার স্থানীয় কুমার সম্প্রদায়ও ছিকর তৈরি করে বাজারজাত করতেন। বর্তমানে ছিকরের কদর কমে যাওয়ায় তারাও পেশা পরিবর্তন করেছেন।

আজও দেশের কিছু এলাকায় প্রচলিত আছে ছিকর। তবে কমেছে তার জনপ্রিয়তা। বর্তমানে অনেকেই শখের বশে এই মাটির বিস্কুট খেয়ে থাকেন। এখন এর বিকল্প হিসেবে অনেক খাবার আছে। ফলে এক প্রকার প্রায় অবলুপ্তির পথেই হাঁটছে ছিকরশিল্প।