১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রাত ১১:৩৬

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

ঘর পর – ওয়াহেদ হোসেন

বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ফসল বাংলা একাডেমি। এখানে ফেব্রুয়ারি মাসে বই মেলা হয়। কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ- এক কথায় সাহিত্য মেলায় বই বিকি-কিনির হাটের সমারোহে সাহিত্য ও সস্কৃতি চর্চার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। নতুন নতুন সাহিত্য প্রতিভার জন্ম ও প্রতিষ্ঠা পাবার এক মিলন কেন্দ্র বাংলা একাডেমি।

বাংলা একাডেমি চত্বরঃ

১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান মালার একটি দিনের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। দর্শক-শ্রোতার চেয়ারে বসে স্ত্রী-কন্যা সহ হাসান।

উপস্থাপনা চলছে। কবিতা পাঠ করতে এসে দু’ একজন কবি আসরে উপস্থাপনাগত ত্রুটির কথা বললেন। বললেন, মুখ চেনাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং আরো কিছু।

ছড়া পড়লেন জাকারিয়া রফিক। হাসানেরও একটা কবিতা লেখা ছিল একুশকে কেন্দ্র করে। কবিতাটা কাছে না থাকায় সে এ আসরে অংশ নিতে পারলো না বলে মনে মনে নিজের ওপর অভিমানহত হলো। লেখাটা একটা সংকলনে দেয়া হয়েছে যা এখনো ছাপা ঘরে।

জাকারিয়া রফিক মঞ্চ হতে নেমে এলে হাসান এগিয়ে গেল।
হাসান পত্নী ওদিকে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক জনাব রশীদ হায়দারের সাথে গল্পে রত। ওরা পূর্ব পরিচিত।
আপনার ছড়াটা আজকের এ পর্যন্ত পড়া সবার সেরা মনে হয়েছে আমার কাছে।
জাকারিয়া বিনয়ে গলে পড়েন। কি যে বলেন। কত ভাল ভাল কবি আছেন। আমি তো পেশাদার কবি-সাহিত্যিক নই।
আপনার ঠিকানাটি কি দেবেন দয়া করে?
হাসানের পকেট নোট বইতে জাকারিয়া তার নিজের ঠিকানা লিখলেন খস খস করে।
আমি যাব এবং আপনার সাথে দেখা করব।
জ্বী আসবেন। খুশী হবো।

হাসান অনেকটা বাউন্ডুলে স্বভাবের । শরৎচন্দ্র, নজরুল তার আদর্শ। ছাপ্পান্ন বছর বয়স পর্যন্ত সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন কিছু করতে পারেনি। পান্ডুলিপির বান্ডিল বানিয়েছে। একটা উপন্যাস ছাপিয়েছিল নিজের পয়সায়। কিছু বিক্রি, কিছু হারানো এবং কিছু দান-খয়রাত-বিতরণে শেষ।

১৯৯৩ সালের বই মেলায় গল্পের একটা বই নিজের খরচে বের করে। সেটি বই মেলায় চলেনি। দশ কপিও বিক্রি হয় নি। পরবর্তীতে কিছু বিক্রি, কিছু দান, খয়রাত-বিতরণে নিঃশেষ প্রায়। এ বইটা না চলার কারণ হিসেবে মন্তব্য পেয়েছেঃ প্রথমতঃ নতুন লেখক; দ্বিতীয়তঃ পাঠক রমরমা উপন্যাস চায়। গল্প নয়; তৃতীয়তঃ বইয়ের নামকরণ যথাযথ নয়; চতুর্থতঃ প্রচ্ছদ গ্রহণযোগ্য নয়। হাসান সবকটি মন্তব্য মেনে নিয়েছে। আর একটা গল্পের বই বের করার উদ্যোগী হয়ে প্রচ্ছদ আগাম ছাপিয়ে রেখেছে। ইতিমধ্যে মফঃস্বলে তার নিজস্ব ছাপাখানা বিক্রি করে দিয়েছে। অবিস্মরণীয় প্রকাশনীতে হাসান চাকরী নিল প্রুফ রীডারের। তার আশা নামকরা প্রকাশনীতে কাজ করলে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের সুযোগ হবে।

জাকারিয়া রফিকের বাসা ও কর্মক্ষেত্র ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার কালীগঞ্জ। হাসান একদিন তার কর্মস্থল হিমেল গার্মেন্টস-এ গেল। দেখা পেল না। ঠিকানা রেখে এলো যেন সময় ও সুযোগ মত দেখা করেন।

অবিস্মরণীয় প্রকাশনীতে জাকারিয়া এলেন। গল্প হলো অনেক। আরো অনেক বাকী রইলো। হাসান আমন্ত্রণ জানালো তার বাসায় আসতে।
দিন কয়েক পর জাকারিয়া এলেন হাসানের বাসায় আলাপ হলো। ‘আমরা তিন জন’ নামে একটা গল্প সংকলন সৌজন্য উপহার দিলেন হাসানকে। লেখক তিনজন- জাকারিয়া, রফিক, রহমান আনিস ও সুমন বিপ্লব। হাসানও তার লেখা গল্পটি সৌজন্য কপি দিল জাকারিয়াকে।

উপহার পাওয়া বইটি পড়লো হাসান। ভাল লাগলো সুমন বিপ্লবের গল্প। এক ছাত্র শ্রেণিতে পড়া পারত না। ক্লাসে শিক্ষকের হাতে মার খেতো। হেড স্যার একদিন পিটুনি দিয়ে বললেন, পড়া পড়ে আসতে পারলে ক্লাসে এসো, নতুবা নয়। সে ছাত্র ক’দিন আর আসেনি। তারপর একদিন এলো। স্যার বললেন, কি ব্যাপার, পড়া কি হয়েছে? সে ছাত্রকে অতঃপর যেখান হতেই পড়া ধরা হলো ঝটপট উত্তর দিল। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সে পড়াশুনার মত দুরূহ কাজ সম্পন্ন করেছে।

এই গল্প হাসানকে আকৃষ্ট করল। জাকারিয়া রফিক ও হাসানের আবার দেখা হলো। সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করলো। সুমন বিপ্লবের কথা হলো

খুলনার ডুমুরিয়া থানার শাহপুর গ্রামের ছেলে সুমন বিপ্লব। বেশী দূর পড়াশুনা করতে পারেনি। মায়ের সাথে পারিবারিক বিষয়ে মতান্তরে সে দেশান্তরী। ঢাকায় ছিল ক’বছর। এখন সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার আকিলপুর গ্রামে থাকে। গত পাঁচ বছর ধরে আছে। গ্রামে শিক্ষার আলো জ্বালাবার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রতিভা পাঠাগার নামে একটা পাঠাগার গড়ে তুলেছে অক্লান্ত প্রচেষ্টায়।

মনে মনে পছন্দ করে ফেললো সুমনকে। ওর ঠিকানা আছে? বললো হাসান।

সঠিক ঠিকানা নেই। দৈনিক সিলেট বাণীর ঠিকানায় লিখলে সুমন সে চিঠি পাবে, বললেন রফিক।

হাসান লিখলো সুমনকে।

সুমন সিলেট বাণীতে চাকরী করে না। লেখালেখি করে। ডাকে পাওয়া চিঠি টা একজন তুলে দিল সুমনের হাতে। সুমন লিখলো হাসানকে। শৈশব নামের একটা শিশু পত্রিকা পাঠালো সৌজন্য স্বরূপ।

চিঠি আদান প্রদান হলো।

হাসান চাকরী ছেড়ে দিল প্রকাশনীর। প্রকাশনীর মালিক সুন্দর জায়নামাজ, টুপি, তসবি ও ফুলের তোড়া দিয়ে বিদায় জানালেন হাসানকে কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি এলো হাসানের। ওর শরীর দিন কতক খারাপ যাচ্ছিল।

আইন পাস দিয়েছে বছর বারো। কমবেশী ওকালতি করলেও বাউলমনা নামটা তার সদা উদাস থাকে। মনটা তার ভেঙ্গে পড়েছে। নিজের ঘর যেন নিজের নয়। স্ত্রীকে বিয়ের রাতে রাজলক্ষ্মী হবার জন্যে বলেছিল। হাসানের মতে স্ত্রী তার উপার্জনক্ষম হয়েছে বটে। কিন্তু রাজলক্ষ্মী হয়নি, হয়নি বিবি রহিমা। আর তাই মনটা তার অচেনায় বেড়িয়ে পড়তে উদগ্রীব।

সুপ্রীম কোর্টে ১৯৮৭ সালে এসে কিছুদিন ওকালতি করেছিল। তারপর মফঃস্বলে ফিরে যায়। এবারেও সে সুপ্রীম কোর্টে ওকালতিতে মন দিতে চাইল। স্ত্রী তার আগ হতেই সুপ্রীম কোর্টে আইন পেশায় সফলতা এনেছে।

হাসানের মনে হয় ঘর তার কাছে পর হয়ে গেছে এবং দূরত্ব আরো বাড়ছে। মনে মনে আর একবার শরৎচন্দ্র হলো, হলো নজরুল, সুমন বিপ্লব।

বাসায় জানান না দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ১৯৯৮ এর ভয়াবহ বন্যা দেশব্যাপী। আগষ্টের তিরিশের বেলা একটায় কৌশলে ঘর হতে বেরুলো নিজের মেয়ের চোখের সামনে দিয়ে। অগ্রাধিকারে সুমন বিপ্লবকে বেছে নিল।

উপবন রেলে চেপে বসলো কমলাপুর রাত দশটায়। পরদিন সকাল ৮ টায় সিলেট পৌঁছে প্রথমে জগন্নাথপুরের বাসে চেপে বসলো। নামলো বিশ্বনাথে। সেখানে আকিলপুর নেই। নানান জনের কাছে জিজ্ঞেস করে হাসান সিলেট ফিরে সুনামগঞ্জের বাসে চাপলো। নামলো গোলচন্দ বাজার। সেখান হতে পেছনগামী হয়ে লামাকাজী এলো। ব্রীজের তলা হতে নৌকায় চাপিয়ে নিয়ে এল এক মাঝি। সে সুমনকে চিনে। সুমন থাকে আকিলপুরে আনফর আলীর ছেলে মুক্তার আলীর বাড়িতে।

হাসান তার গন্তব্যে এলো বটে। কিন্তু সুমনকে পেলনা। সিলেট শহরে গেছে। আসবে ২/৩ দিন পর। মুক্তার আলীও বাড়িতে নেই। তার চাচাতো ভাই সফর আলী অচেনা হাসানের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বললেন। মুক্তার আলীর বাড়িতে উপস্থিত খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সিলেট শহরে কাউকে পাঠিয়ে সুমনকে আনার চেষ্টা করলেন। হাসান নিজেই সিলেট যেতে ইচ্ছুক হলে তিনি দৈনিক সিলেট বাণীর ঠিকানা দিলেন।

হাসান ছুটলো। সুমনকে পাওয়া গেল না। পত্রিকা অফিসের হৃষিকেশ রায় শংকর চেষ্টা করলেন সুমনকে খুঁজে পেতে। কখনো কখনো রাতে শোয়ার জন্য সুমন পত্রিকা অফিসে আসে। এমন খবর হলো।

হাসান একটা হোটেলে উঠল।

পরদিন সকাল দশটায় হাসান বসে দৈনিক সিলেট বাণীতে। হৃষিকেশ দা বললেন, দেখতো সুমন, এ ভদ্রলোককে চিন কি না?
হাসান একটা চেয়ারে বসেছিল। সুমন এগিয়ে গেল।

না, কেউ কাউকে চিনে না।
আমি হাসান। চিঠিতে আমাদের আলাপ।

ওহ হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো। ওই মুহুর্তে সুমনের ব্যস্ততা। কাজে চলে গেল। এল আবার গেল। একবার হাসানকে নিয়ে সুমন গেল মায়া ওয়াহেদের বাসায়। সিলেট পি টি আই এই সুপারিনটেন্ট।

হাসান স্পষ্টতঃ বলতে না চাইলেও কথা প্রসঙ্গে যা বেড়িয়ে এলো তাতে সুপারিনটেন্ডেন্ট বুঝলেন সুমনের মতই এ আর এক বৈরাগী। বেড়িয়ে পড়ার আপেক্ষিকতা নিয়ে কথকথা হলো। মায়া ওয়াহেদ না খাইয়ে ছাড়লেন না। হাসান তাঁর মাঝে দেখতে পেল এক মহিয়সী নারীর ছোঁয়া।
হাসান ও সুমন বেরিয়ে এল সেখান হতে। সিলেট শহরে আরো একদিন কাটিয়ে ওরা দু’জন আকিলপুর এল।

হাসানের মন উচাটন। তার মনের বন পুড়ছে। বৌ-ছেলে-মেয়ে ফেলে পরাভুইয়ে কি হাতী ঘোড়া মারবে আল্লাহ-ই মালুম।

আমরা সাহিত্য সংস্কৃতিতে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবোই, দৃঢ় প্রত্যয় সুমন বিপ্লবের। হাসানকে পেয়ে সে বলশালী হতে চায়। ওরা হাতে হাত মিলায়।
মুক্তার আলী একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান। মুক্তার আলী ও তার স্ত্রী হাছিনা বেগমের আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও মমতা এক নব বাঁধনে বাঁধছে হাসানকে। নিজের ছেলে মেয়ে হতে দূরবর্তী হয়ে অচিন জায়গায় মুক্তার আলীর তিন বছরের মেয়ে তামান্না ও এক বছরের ছেলে মুরাদকে কোলে-পিঠে আদর করে বুকের মরুতৃষা মেটাচ্ছে। মুক্তার আলী ও তার স্ত্রী চাচা সম্বোধন করেছে। হাছিনা ও তার ছোট বোন আট বছরের রুনা খাওয়া দাওয়া ও যত্নআত্তি করেছে তার নিজের বাসার যত্নের তুলনা করলো হাসান। নিখাদ এ ভালোবাসার সাথে নিজ পরিবারের ভালোবাসাকে খাদযুক্ত মনে হলো। তবু বহু বছরের একত্র বাসের ফলে সৃষ্ট মমতাকে সে ভুলতে পারছে না। সুমনকে উদ্দেশ্য করে হাসান এখানে এসেছে। একদিন সুমন বিপ্লবকে ও মুক্তার কুড়িয়ে এনেছিল হযরত শাহজালাল (রহঃ) এ মাজার হতে। মানুষ ছোট, কিন্তু হৃদয়ের পরিধি বিরাট।

“ঘরের চাইতে পর ভাল, পরের চাইতে জঙ্গল” এ প্রবাদ বাক্যটি এখন হাসানে মনে পড়ছে কেন কে জানে?

ওয়াহেদ হোসেন
যুক্তরাজ্য প্রবাসী