৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রাত ১:১৩

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

চোরে চোরে মাসতুতু ভাই

চোরে চোরে মাসতুতু ভাই

পর্ব ১ঃ

BIRDS OF A FEATHER, FLOCK TOGETHER

লন্ডন থেকে মোহাম্মদ আজিজঃ

আদিকাল থেকেই লোকসমাজে সংঘঠিত ঘটনাবলী থেকে অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজের জ্ঞাণী, গুণী, মানব হিতৈষীগণ অনেক উপমা বা কথা বলে গেছেন । কালে কালে ঘটনা পরিক্রমায় তাদের অভিজ্ঞতার নির্যাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম লোকসমাজে প্রবাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । গ্রামবাংলার এমনই একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো- “ চোরে চোরে মাসতুতু ভাই “।

প্রাচীনকালে গ্রামবাংলায় শান্তি শৃংখলা রক্ষা ও অপরাধ দমনে ঐতিহ্যপূর্ণ সালিশী বিচার পদ্ধতি ছিল নিয়ামক শক্তি । দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চুরি-চামারী ও অনৈতিক কার্য্যকলাপ রোধে সালিশী বিচারের বিকল্প ছিলনা । আমার শৈশবে আমাদের এলাকায় বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ সালিশী বিচারক ছিলেন । নিরপেক্ষ ও ন্যায় বিচারক হিসাবে তাদের সূখ্যাতি ছিল । তাদের একজন এক সালিশী বিচারে চোরে চোরে মাসতুতু ভাই প্রবাদটির জট খোলেছিলেন । তিনি বলেছিলেন একজনের অন্যায় কাজে আরেকজন সহযোগিতা করলে বা সায় দিলে তাদের একজনকে আরেকজনের সহযোগী বুঝাতে ‘চোরে চোরে মাসতুত’ ভাই প্রবাদটি ব্যাবহার করা হয় । উদাহরণ হিসাবে তিনি বেশ মজা করে একটি গল্প বলেছিলেন । গল্পটি ছিল এরকম যে একবার এক দল চোর নাকি গভীররাতে কোন এক বাড়ীতে চুরি করতে গিয়েছিল । অতি লোভে বেশী মালামাল চুরি করতে গিয়ে প্রায় ভোরের আলো উদয় হওয়ার উপক্রম হয়েছিল । তখন চোরেরা ভাবলো এই আলোতে চোরাই জিনিসপত্র নিয়ে বের হলেতো তাদের ধরা পরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । তখন এক চোর তার সঙ্গী সাথীদেরকে পাশের ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল । সকল চোর তার পরামর্শনুযায়ী একসাথে জঙ্গলে লুকিয়ে গেল । জঙ্গলে গিয়ে চোরের দল একটা পরিত্যাক্ত চৌকি বা খাটিয়া পেয়ে গেল । সঙ্গের এক চোর বুদ্ধি করে খাটিয়ার উপর একটা চাদর বিছিয়ে চোরাই মাল চাদর দিয়ে মুড়িয়ে নিল । সে সাথী চোরদেরকে এই খাটিয়া কাঁধে নিয়ে “হরিবল-হরিবল” জপতে জপতে বাহিরে যাওয়ার পরামর্শ দিল । অন্য চোরদেরকে বুঝাল, তার কথামতে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে বাহিরে গেলে মানুষ ভাববে আমরা সত্যি কোনো মৃত ব্যক্তিকে সৎকার করার জন্য শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছি । এতে কেউ সন্দেহ করবে না । সকল চোরেরা তার বুদ্ধির প্রসংসা করে পরিকল্পনা মতো বাহিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো । এই সময় চোরদের সামনে এক আগন্তুক এসে হাজির হলো। আগন্তক চোরদেরকে ইঙ্গিত করে কিছু বুঝাবার চেষ্টা করলো । সে যে সুবিধার কেউ ছিলনা তা বুঝতে চোরদের মোটেই অসুবিধা হলনা । মূলতঃ আগন্তক নিজেও একজন চোর ছিল । সে চাদরের বাহিরে চুরির মালামাল দেখা যাচ্ছে বলে চোরের দলকে ইশারায় সাবধান করেছিল । এভাবে বাহির হলে সকলে ধরা পরার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাল। তাই সে অন্য চোরদেরকে মালামাল গুলোকে এমন ভাবে বাঁধ দিতে বলে যেন খাটিয়ার উপরে রাখা জিনিষ গুলোকে দেখতে একটা লাশের মত মনে হয় । চোরেরা ভাবলো ঘটনা সত্য । তাই একে অপরকে বললো যদি এই লোক সাবধান না করতো তাহলে তারা বাহির হলেই ধরা পরে যেত এবং রামধোলাই খেত । আগন্তকের বুদ্ধিমত্তা দেখে অন্য চোরেরা খুশি হলো । তখন আগন্তক অন্য চোরদের কাছে চোরাই মালের ভাগ দাবী করে । উপায়ন্তর না দেখে সকলেই তাকে ভাগ দিতে সম্মত হয় । চোরের দল তাড়াতাড়ি মালামাল লাশের মত করে ঢেকে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে “ হরিবর হরিবল জপতে-জপতে সকল বেড়িয়ে গেল।আগন্তককে খাটিয়া বহন করতে দেখে চোরের দল মহা খুশি। চুরির মালে ফাও ভাগ পাওয়ার জন্য আগন্তুকও বেজায় খুশী। সবাই মিলে ‘হরিবোল-হরিবোল’ ধ্বনি তুলে এগিয়ে যেতে লাগলো। পথচারীরা তো জানেনা যে ওরা চোর এবং ভাগাভাগি করে সবাই মিলে চোরাই মাল সরাচ্ছে । চোরদের সাথে খাটিয়া বহনকারী আগন্তককে চিনতে পেরে এক পথচারী তাকে জিজ্ঞেস করলো “মাসি “ কখন মরেছে ? কোন উত্তর না দিয়ে আগন্তক খাটিয়ায় কাঁধ রেখে নির্বাক থেকে বুঝিয়ে দিলো সে শোকে মূয্যমান । কিছু না বলার জন্য আগন্তক অন্য চোরদেরকে ইশারায় সাবধান করে দিল । চোরাই মাল সরিয়ে নিতে যে আগন্তক অন্যদের সাথে হরিবল-হরিবল জপতে জপতে মরা মাসির খাটিয়া বহন করতে সহায়তা করেছে সেই লোকটি ও অন্য সকল চোরেরা হলো পরস্পরের মাসতুতু ভাই । এভাবেই ভাগাভাগি করে চোরাই মাল সরিয়ে নিতে দুই চোর একে অপরের সঙ্গে মাসতুতু ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে তোলে । কোনো চুরি বা অবৈধ কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করলে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে চট করে চোরে চোরে মাসতুতু ভাই প্রবাদটি বলে দেওয়া হয় জনসমাজে।

লেখকঃ কমিউনিটি লিডার ও প্রেসিডেন্ট, হবিগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, ইউকে৷