বন ও পরিবেশ রক্ষায় মাঠপর্যায়ে যারা নিরলসভাবে কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই স্বেচ্ছাসেবক। কেউ কোনো সরকারি বেতন পান না, বরং অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেন। অথচ তাদের জন্য সরকারের পুরস্কার নীতি থাকলেও—বাস্তবে সেই অর্থের দেখা মেলে না।
২০২০ সালের ৪ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়—বন্যপ্রাণী উদ্ধার, পাচার প্রতিরোধ বা অপরাধী ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি বা সংগঠনকে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক পুরস্কার প্রদান করা হবে। নির্দেশনায় আরও উল্লেখ রয়েছে—হাতি উদ্ধারে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার, বাঘ বা চিতা জাতীয় প্রাণীর ক্ষেত্রে ৩০ হাজার, হরিণের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং পাখি উদ্ধারে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার। মামলা হলে পুরস্কারের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
কিন্তু মাঠের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। খুলনা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবীরা অভিযোগ করেছেন—বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিয়মিত এই অর্থ আত্মসাৎ করেন।
তারা মাঠপর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবীদের নাম ব্যবহার করে পুরস্কারের টাকা নিজেদের নামে তোলেন। অনেক স্বেচ্ছাসেবী পুরস্কারের বিষয়টি জানতেও পারেন না; পরে জানতে পারেন, তাদের নামেই টাকা তোলা হয়েছে।
হবিগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবক আব্দুল জাহির বলেন,
“আমরা ৫০টিরও বেশি উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছি, কিন্তু কখনো পুরস্কার পাইনি। এখন শুনছি, আমাদের নাম ব্যবহার করেই অন্যরা টাকা তুলে নিচ্ছেন।”
খুলনা অঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আলোর মিছিল-এর সভাপতি শেখ তারেক বলেন,
“বিধিমালা আছে, পুরস্কারের টাকাও বরাদ্দ আছে—কিন্তু মাঠের মানুষ কিছুই পায় না। সাত-আটটি ঘটনায় অংশ নিয়েও কোনো পুরস্কার পাইনি।”
হবিগঞ্জের আরেক স্বেচ্ছাসেবী আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন,
“২০ থেকে ৩০টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছি, হরিণ পর্যন্ত উদ্ধার করেছি। কিছু ঘটনায় মামলা হয়েছে, কিন্তু আর্থিক পুরস্কারের নামগন্ধও পাইনি।”
সূত্র জানায়, পুরস্কার তহবিলের অর্থ একটি নির্দিষ্ট কোডের মাধ্যমে প্রধান বন সংরক্ষক, উপপ্রধান সংরক্ষক, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক, বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং ঢাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমোদনে উত্তোলন করা হয়।
তবে বাস্তবে সেখানে নাম জালিয়াতি, নথি গোপন এবং “নিজেদের লোকদের” অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে এই খাতে লাখ লাখ টাকারও বেশি অর্থ বণ্টনের নামে লোপাট হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন,
“যদি কোনো বন কর্মকর্তা নিয়ম ভেঙে টাকা তোলেন, সেটি অবশ্যই অন্যায়। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে তিনি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি শুধু দুর্নীতির গল্প নয়—এটি প্রকৃতিপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতি এক ধরনের অবমাননা। তারা যদি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন, তাহলে মাঠে আর কেউ বন্যপ্রাণী উদ্ধারের ঝুঁকি নেবে না।
বন বিভাগ চাইলে খুব সহজেই এই অনিয়ম বন্ধ করতে পারে—শুধু প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত, ডিজিটাল যাচাইব্যবস্থা এবং প্রকৃত উদ্ধারকারীদের হাতে সরাসরি পুরস্কারের অর্থ প্রদান।
তবেই বনের প্রাণীরা বাঁচবে, বাঁচবে প্রকৃতিও।


