১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৭:৫৬

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

সিয়াম সাধনায় আউলিয়া কেরাম

মাহে রমযান। মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার। আল্লাহকে কাছে পাবার অন্যতম মাধ্যম এটি। এ মাসের সিয়াম-সাধনা কেবল আল্লাহর জন্য। এখানে নেই লৌকিকতার আড়াল। নেই কোন কৃত্রিমতার বেড়াজাল। তাই দীর্ঘ একমাস কৃচ্ছ্র-সাধনার প্রতিদান- আল্লাহর দীদার; যা মুমিন মাত্রই প্রত্যেকের বাসনা। প্রতিটি মুসলমান-ই এ স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকেন। অতএব স্বপ্ন-পূরণের জন্য চাই নিরন্তর সাধনা। আর আমাদেরকে এ কষ্টসঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে হবে পূর্বসুরীদের অনুকরণ ও অনুসরণের দ্বারাই। নিচে আমরা সর্বজনস্বীকৃত আউলিয়া কেরামের সংযম সাধনার চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করছি। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাআলা-ই তাঁর বান্দার একমাত্র সহায়।

মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহ. :
সময় জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এটি বহতা নদীর মতো। কেবল বয়েই যায়। কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তাই এর প্রতি সবচে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন আমাদের পূর্ববর্তী আকাবিরগণ। এ ক্ষেত্রে হযরত খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রহ, আমাদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি ঘড়ির সময়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতেন। ডাক ও টেলিফোন অফিসের সাথে সময় মিলাবার জন্য তাঁর আলাদা লোক নিয়োজিত ছিল। তিনি ঋতুভেদে সুবহে সাদেকের প্রায় ২/৩ ঘন্টা পূর্বে ঘুম থেকে জাগতেন। অতঃপর সুবহে সাদিকের প্রায় আধ ঘন্টা পূর্বে সাহরী খেতেন। তিনি তাঁর ইফতার পঞ্জিকার সময় থেকে সতর্কতামূলক ২/৩ মিনিট বিলম্বে করতেন। [আউলিয়া কেরামের সিয়াম সাধনা]

মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. :
লিল্লাহিয়াতের বিমল প্রভায় এই মহান মনীষীর জীবন ছিল জ্যোতির্ময়। তাঁর সিয়াম-সাধনা এ আমলহীন উম্মাতের জন্য এক জীবন্ত আদর্শ। রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে তাঁর ঘুম ভেঙ্গেঁ যেতো। এ সময় তিনি ঘন্টা তিনেক তাহাজ্জুদে নিমগ্ন থাকতেন। কখনো কখনো ভোর ৫টাও বেজে যেতো। ফজরের পর তিনি ৮টা পর্যন্ত ওজিফা, জিকির-আজকার, মোরাকাবা ইত্যাদিতে তন্ময় থাকতেন। অতঃপর ইশরাক পড়তেন। সামান্য সময় বিশ্রাম করতেন। চিঠি-পত্র ও ফতোয়ার জবাব লিখতেন। চাশতের নামায আদায় করতেন। যোহরের পর কামরার দরজা বন্ধ হয়ে যেতো। হযরত আসর পর্যন্ত কালামে পাক তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। বার্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতা ছাড়াও এক রমযানে হযরতের এমন ভীষণ কোমর ব্যাথা ছিল যে, কামরা থেকে ইস্তিঞ্জায় যাওয়ার সময় পথে বসতে হতো। অথচ কামরা থেকে ইস্তিঞ্জাখানার দূরত্ব ছিল মাত্র পনের-ষোল কদম। আর এমন সময় হযরত ফরজ তো দূরের কথা কোন নফল নামাযও বসে পড়েননি। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন। খাদেমরা বারবার আরয করতেন যে, হযরত আজ তারাবীহ নামায বসে পড়লে ভালো হতো। কিন্তু হযরত জবাব দিতেন, “না, এটি কম হিম্মতির কথা। এতটুকু হিম্মত ছাড়া ঐ মহান ব্যক্তির উত্তরসূরী হওয়া সম্ভব নয়; যিনি বলেছিলেন-। আমি কি তাহলে কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? [আউলিয়া কেরামের সিয়াম সাধনা]

মাওলানা কাসেম নানূত্ববী রহ.:
কুরআন আমাদের পথনির্দেশক। একটি শাশ্বত জীবন-বিধান। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর সব কল্যাণ। তাই ১২১৬ হিজরীর পবিত্র রমযানে হযরত নানূতুরী রহ, কুরআনে কারীম হিফজ করেছিলেন। তখন তিনি মদীনার মুসাফির ছিলেন। যাওয়ার পথে জাহাজে চালাকালেই রমযানের চাঁদ দেখা যায়। রমযানের চাঁদ দেখার পর হযরত কুরআনে কারীম মুখস্ত করা শুরু করেন এবং সেখানেই শুনাতে থাকেন। এভাবে রমযানের মধ্যেই কুরআন শরীফ মুখস্ত করে ফেলেন। পূর্ণ মুখস্ত শেষে শুকরিয়াস্বরুপ বন্ধুদের মধ্যে মিষ্টান্ন বিতরণ করেন। হিফজ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কেউ তার হিফজের খবর জানতো না। হিফজ শেষে অধিক মাত্রায় কুরআনে কারীম তেলাওয়াত করতেন। নফল নামাযে কেউ তার পেছনে ইক্তেদা করলে দু রাকাত শেষে তাকে ইক্তেদা করতে নিষেধ করতেন। একা একা সারা রাত্র নামায পড়তে থাকতেন। আর এই নিষেধাজ্ঞা এজন্য ছিল, যেন তাঁর কষ্ট না হয়। হযরত পুরো রাত নফল নামাযে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতেন। [সাওয়ানেহে কাসেমী]

হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ,:
যৌবন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তাই মক্কী রহ. যৌবনের অধিকাংশ সময় বিনিদ্র রজনীযাপন করেছিলেন। মাহে রমজানে তাঁর রাত্রিযাপন আমাদের জন্য এক অনুপম আদর্শ। তিনি এ পবিত্র মাসে মাগরিবের পর দু জন হাফেজ থেকে সোয়া পারা করে ইশা পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াত শুনতেন। তাদের একজন ছিলেন হাফেজ ইউসুফ। আরেকজন হাফেজ আহমদ হুসাইন। ইশার পর আরো দুজন থেকে তিনি কুরআন তিলাওয়াত শুনতেন। তাদের পর একজন হাফেজ তাঁকে অর্ধ রাত পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াত শুনাতো। তাহাজ্জুদের নামাজেও মক্কী রহ. দুজন হাফেজ থেকে কুরআনে মধুর বাণী হৃদয়ঙ্গম করতেন। মোটকথা, সারা রাত তাঁর এভাবেই কেটে যেত। [ইমদাদুল মুশতাক]

মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.:
হযরত থানভী রহ. রমযানের তারাবীতে সাধারণত নিজেই কুরআন শুনাতেন। কোন ওযর ছাড়া কখনো তা বাদ দেননি। অর্ধেক রমযান পর্যন্ত সোয়া পারা এবং তারপর থেকে এক পারা করে দৈনিক পড়তেন। রমযানের সাতাইশতম রজনীতে খতম করতেন। স্বাভাবিকভাবে নামাযে যে রকম তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করতেন, তারাবীতেও সেভাবেই পড়তেন। যদি কখনো দ্রুত পড়তে হতো, তাহলে ধীরে পড়ার সময় শব্দোচ্চারণের যে মান ছিল, তা-ই বজায় থাকতো। হযরত থানভী রহ. ওয়াকফ এবং লাহজার প্রতি যেরূপ লক্ষ করতেন, এভাবে খুব কম সংখ্যক লোকই তিলাওয়াত করে থাকে। তাঁর ইয়াদও খুব চমৎকার ছিল। কুরআনোর সাথে হযরতের এতো বেশি গভীর সম্পর্ক ছিল যে, মনে হতো পুরো কুরআন আদ্যপান্ত তাঁর চোখের সামনে রয়েছে। কোন শব্দ বা আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি তা তৎক্ষনাত বলে দিতে পারতেন। [মামুলাতে আশরাফিয়া]

মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.:
হযরত মাদানী রহ. এর মধুর লাহাজ বা উচ্চারণ ভঙ্গিতে কুরআন তিলাওয়াত এবং তাঁর নামাযের বিরল খুশু-খুজু ও একাগ্রতার কথা শুধু ভারতেই নয়; বরং গোটা আরবেই প্রসিদ্ধ ছিল। সিলেটে হযরত রহ. নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং তারাবীর ইমামতি করতেন। তাই তারাবীতে হযরতের পিছনে কুরআন তিলাওয়াত শুনার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে দৈনিক লোকজন আসতেন। তারা তারাবীহ নামায পড়তেন। সারারাত যেখানেই অবস্থান করতেন। তারপর তাহাজ্জুদে অংশগ্রহণ করে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতেন। [আউলিয়া কেরামের সিয়াম সাধনা]

পরিশেষে বলতে চাই, রহমত মাগফিরাত আর নাজাতের মহাসওগাত নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে হাজির হয় মাহে রমযান। এ মাসের সিয়াম সাধনায় নিমগ্ন থেকে আমরা আল্লাহর প্রেম অর্জন করতে পারি। েেহ আল্লাহ ! আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন !

লেখকঃঃ মাহমুদ হোসেন