৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
দুপুর ১২:৪৩

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

একটি নদীর আত্বকথা

মোঃ বাহার উদ্দিন

লাখাই উপজেলার হাওর বেষ্টিত অঞ্চল বুল্লা ইউনিয়নে আমার অবস্থান। আমার নাম মরা নদী। কিন্তু স্থানীয় লোকজন যাহারা আমাকে ভালোবেসে আমার কোলে বসবাস করছে তারা বলে মরা গাঙ। আসলে কি আমার জন্মলগ্ন থেকে হাজার বছর কি নামে পরিচিত ছিলাম। কালের পরিক্রমায় দিন বদলের পালায় আমার যে পরিবর্তন তাহা বলার জন্যই আমার ব্যাকুলতা এবং আজকের এ লেখার অবতারণা।

received 2902657376657755

আমি প্রতিদিন দেখি কতজন আসে আমাতে স্নান করে, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে ক্লান্তি দূর করে। পথিক আমার জল পান করে তৃষ্ণা মিঠায়। জন্ম থেকে আমৃত্যু আমার প্রয়োজন স্রষ্টার স্রৃষ্টির অসংখ্য প্রাণীর জন্য। কিন্তু আমার কথা শুনার বা ভাবার জন্য একজনকেও পাওয়া যায়নি আজ অবধি। আমার জন্ম কখন কিভাবে হয়েছে তা আমার জানা না থাকলেও এতটুকু বুঝেছি প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমাকে সৃষ্টি করেছে। আমি ছিলাম অত্যন্ত গভীর এবং নীল জলরাশির আধার।

আমাকে কেন্দ্র করে আমার পূর্ব তীরে বুল্লা ইউনিয়নের বলাকান্দি, দক্ষিণ তীরে ভবানীপুর, দক্ষিণ পশ্চিম তীরে পূর্ণীবাড়ি ও চানপুর এবং উত্তর তীরে দিগন্তজোরা ফসলের মাঠ। এ গ্রামগুলো আমার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল এবং আজও বর্তমান। কালের পরিক্রমায় আমারও আমূল পরিরর্তন এসেছে। সৃষ্টিলগ্নে চারটি খালের মাধ্যমে নদী ও উপসাগরের সাথে যোগাযোগ ছিল। জালখালি খালের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল খোয়াই নদীর সাথে, বলাকান্দি খালের মাধ্যমে শাখাতি নদীর সাথে, বড় খালের মাধ্যমে মেদীর হাওর ও পূর্ণীবাড়ি খালের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল শামসী নদী হয়ে মেঘনার সঙ্গে। প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমাতে ঘটত জোয়ার-ভাটা। আমি হয়ে উঠতাম চঞ্চল। আজ আমার সেই অবস্থা শুধুই অতীত।

মানুষ আপাত দৃষ্টিতে তাদের সুবিধার জন্য আমার খালগুলো বাধঁ দিয়ে আমাকে করেছে বন্দি। তাই জন্মলগ্নে পরিচিত ফিরানি নদী আজ মরা নদী। আমি মরা নদী হওয়ায় আমার সেই নাব্যতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিকাজে আমার জল ব্যবহারের জন্য কার্তিক মাস থেকে দুই তীরে প্রায় তিরিশ টি সেচ পাম্পের মাধ্যমে শুরু হয় সেচকার্জ। ফলশ্রুতিতে চৈত্র মাসে আমার শতকরা ষাট ভাগ শুকিয়ে যায়। আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায় এবং তাতে গবাদি পশু মনের আনন্দে ঘাস খায় আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করে। এতকিছুর পরও আমার বুকফাটা করুণার্থনাদ, কোনো বিবেকবান মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। যেন আমাকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই। এককালে আমি ছিলাম এ এলাকার অফুরন্ত মৎস্য ভান্ডার, বর্তমানে যাহা শুধুই ইতিহাস। আমি শ্রোত হারিয়েছি, আমার শাখাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, আমার তীরবর্তী গ্রামগুলোর হাজামজা ময়লা-আবর্জনা নিত্য এসে আমাকে দূষিত করে চলেছে। এতকিছুর পরেও ৬৯.৬২ একরের বিশাল আয়তন নিয়ে ভলোই কাটছিল দিন। কিন্তু মরার ওপর খারার ঘাঁয়ের মত খোয়াই নদীর ভাঙনে আমার বিস্তীর্ণ তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে দিন দিন আমার নাব্যতাও হ্রাস পাচ্ছে। আমি আমার জন্মলগ্ন থেকে অধ্যাবদি আমার বিবর্তনের ক্রমধারা বিদৃত করিলাম কিন্তু পাঠকদের নিয়ে কিছুই বলিনি, কারণ তাদের আমাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আর যখন ভাবার সময় হবে তখন প্রকৃতি কি প্রতিশোধ নেবে তা ভবিতব্য জানে।

প্রতিবেদকের মন্তব্য, আমাদের চারপাশে নদীনালা ও খাল-বিল সবকিছুই প্রকৃতির নিজের প্রয়োজনে তার ভারসাম্য রক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছিল। আপাত দৃষ্টিতে সাময়িক সুবিধার জন্য আমরা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নদীকে রূপান্তরিত করেছি বিলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে খালে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। দেশে অকাল বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে। আমাদের কোনো কিছু করার পূর্বে ভাবতে হবে যা করব তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভালোমন্দ কি হতে পারে? আর তার জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি মূল্যই বা দিতে হবে? এতক্ষণ যা বললাম তা ফিরানি নদীর আত্বকথা। সঠিক দৃষ্টিতে সমস্ত লাখাই উপজেলার চিত্রই প্রায় একরকম। আজ যদি দেখেন আবদ্ধ জলাশয় তখন প্রশ্ন আসবে এর পঞ্চাশ থেকে একশো বছর পূর্বে কি অবস্থা ছিল, তখনই বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে। সামান্য এ কাহিনী বলে দেবে, আমরা কি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো না প্রকৃতিকে তার নিজের মত চলতে দেবো।