বাংলাদেশের চা খাত এখন বহুমুখী সংকটে। কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ না দেওয়ায় নগদ অর্থ সংকটে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি টি কোম্পানির অধীনে ৫ টি চা বাগানে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। জানাযায় , বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুর্শেদ খানের মালিকানাধীন দেউন্দি টি কোম্পানি অধীনে নোয়াপাড়া , লাল চান্দ , দেউন্দি , মিরতিংগা , লস্করপুর চা বাগান গুলো উৎপাদন ব্যবস্থাপনা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে । গত ২০২৪ সালে ২৭ জানুয়ারি ভোর সকাল ৬ টায় লাল চান্দ চা বাগানের কারখানায় শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে গুদামে প্যাকিং মজুদ চা-পাতা , মেশিন সহ বেশ কিছু সরঞ্জাম পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় । ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ – ১১ কোটি টাকা । আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট এসে ৬ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা হয় । এর পর থেকে অর্থ সংকটে কারখানা এখন পর্যন্ত বাগান বন্ধ রয়েছে । বর্তমানে কাঁচা চা পাতা অন্যত্র কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছে । এছাড়া অর্থ নৈতিক দৈন্যদশা এসব বাগানে কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ রয়েছে । বাকি গুলো চলছে স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে । কৃষি ও শিল্প উভয় মাধ্যমে চা উৎপাদন হলেও দেশের চা বাগান গুলো রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে । শ্রমঘন খাত টির উদ্যোক্তরা শিল্পের মতো ঋণ সুবিধা পেলে ও স সামপ্রতিক বছর গুলোয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের বড় পার্থক্যে লোকসানে রয়েছে সিলেট বিভাগে অধিকাংশ চা বাগান । দেউন্দি টি কোম্পানি অধীনে নোয়াপাড়া ও লাল চান্দ চা বাগান গুলোজ সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় এবং নোয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোঃ সোহাগ আহমেদ জানান , দেউন্দি টি কোম্পানির অধীনে নোয়াপাড়া চা বাগান সহ অন্যান্য চা বাগান উৎপাদন বন্ধের পাশাপাশি শ্রমিকদের মজুরি সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে পারছে না বাগান কর্তৃপক্ষ । চা খাতের উৎপাদন পদ্ধতির একটি অংশ কৃষি ধাঁচের হওয়ায় শিল্প প্রকৃতির ঋণ পদ্ধতির কারণে তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে বাগান মালিকরা। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে প্রায় শতভাগ দেশীয় চাহিদা মেটানো চা খাতের এ সংকট নিরসনে ঋণ পদ্ধতি সহজী করণ ছাড়া ও কৃষি ঋণ সুবিধার দাবি তুলেছেন বাগান মালিকরা । বাগান সূত্রে আরো জানা যায় , দেশে প্রতি বছর চা বিক্রি হওয়া শুল্ক – কর ব্যতিত চায়ের মূল্য ২ হাজার কোটি টাকার ও বেশি । সরাসরি পরোক্ষভাবে শ্রমিক চা খাতে কর্মরত । দেশের ১৭০ চা বাগান ও ক্ষুদ্র আকারে উদ্যোগক্তারা বছরে ১০ কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদন করেন । তবে সবচেয়ে ভালো উন্নত মানের চা দেউন্দি টি কোম্পানির। ২০১৮ সালের পর থেকে টানা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে নিলামে চা বিক্রি করতে হচ্ছে চা বাগান গুলো । এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার পরও কৃষি ব্যাংক থেকে দেউন্দি টি কোম্পানিকে ঋণ না দেওয়ায় ৫ টি চা বাগানে তারল্য সংকটে শ্রমিকদের মজুরি , পিএফ, রেশন বকেয়া রাখতে বাধ্য হচ্ছে বাগান গুলো । আর্থিক সংকটে শ্রমিকদের ভবিষ্যত তহবিলে চাঁদা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না । চা সংসদের সদস্যরা জানান , প্রতিটি চা বাগানে চা খাতে কৃষি ব্যাংক হতে ৬৫ – ৭০ শতাংশ ঋণ চা বাগানে ঋণ দিয়ে থাকে । বিপুল বিনিয়োগের খাত টিতে ঋণ প্রদান নিরাপদ হলেও বর্তমানে মোট ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১ শ কোটি টাকার মতো। অন্য খাতে বিপুল খেলাপি ঋণের কথা জানা গেলে ও দেশের চা খাতের উদ্যোক্তাদের খেলাপি ঋণ মাত্র ১০ কোটি টাকার মতো। অথচ অপরাপর শিল্প ও উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে করা কড়ি আরো পের নিয়মটি চায়ের মতো নিরাপদ খাতে ও আরোপ হওয়ায় সংকটে পড়েছে দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে দেউন্দি টি কোম্পানি বাগান গুলো । সামপ্রতিক সময়ে চা খাতের এ-সব সংকট নিরসনে নিয়ম শিথিল করার পাশাপাশি আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন , কয়েক হাজার কোটি টাকার ফান্ড প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন দেউন্দি টি কোম্পানির মালিকরা। বাংলাদেশ চা বোর্ড ও বাংলাদেশী চা সংসদের তথ্য মতে, দেশের চা উৎপাদন – পরবর্তী বিপণন নিলাম নির্ভর। ফলে পণ্যের দাম নির্ধারণে উৎপাদকের কোনো হাত নেই । বিশেষায়িত খাত টির উৎপাদন প্রকৃতির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। বিশেষ করে অনুকূল আবহাওয়া, পরিমিত বৃষ্টি পাত চা চাষের জন্য খুবই জরুরী। এ কারণে ঋণ প্রাপ্তি সহ বিভিন্ন ব্যাংকিং লেনদেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আই সিআর আর) চা খাতে আরোপ করায় উদ্যোক্তারা ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। চা শিল্পের জন্য শস্য বন্ধকি ঋণ পুনঃ তফসিলী করণ ও পুনঃ গঠনের ওপর থেকে আই সিআর আর উঠিয়ে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক , অর্থ মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন দপ্তরে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আবেদন বেশ কয়েক বার জানানো হয়েছে । এ সংক্রান্ত নথি পত্রে দেখা গেছে , দেশের বিভিন্ন চা বাগানের শস্য শস্য ঋণ প্রস্তাব গুলো বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে নি। আরো জানাযায় , মূলত আই সিআর আর অনাপত্তির জন্য দেউন্দি , লাল চান্দ , নোয়াপাড়া , মিরথিংগা, লস্করপুর, সিরাজনগর , রেহানা, মাজান ও আছিয়া চা বাগানের এখন পর্যন্ত ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি। এমনকি ন্যাশনাল টি কোম্পানির অধীনে ১২ টি চা বাগানের সিঙ্গেল বারোয়ারী এক্সপোজার লিমিট বৃদ্ধি /শিথিল করণের জন্য প্রস্তাব দেয়া হলে ও সেটি অনুমোদন হয়নি । এ-সব কারণে দেউন্দি টি কোম্পানি সহ অনেক চা বাগান তীব্র অর্থ সংকটে রয়েছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে । শ্রমিকদের বিভিন্ন পাওনা পরিশোধ করতে পারছেনা। এতে বাগান গুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে । খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন , অনেক শস্য উৎপাদনে ব্যাংক থেকে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে ঋণ পাওয়া যায় । ভতুর্কি মূল্যে সার, কীটনাশক ও বিদ্যুৎ পায় কৃষি পণ্য । কৃষি খাতের উন্নয়ন ও গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুবিধা রয়েছে । দেশের চা খাতের উৎপাদনের একটি অংশ কৃষি সদৃশ হলেও তাঁরা শুধু ভতুর্কি মূল্যে সার পায়। বর্তমানে চা বাগান গুলো সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে বেশ কয়েকটি চা বাগান । অথচ এখনো দেউন্দি টি কোম্পানিকে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে না কিন্তু বাগানের শ্রমিকরা অসন্তোষ হয়ে পড়ছে । নড়বড়ে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা। আবার টানা কয়েকবছর ধরে বেশির ভাগ বাগান উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে কাচা চা-পাতা বিক্রি করায় তাদের পরিচালনা বন্ধের উপক্রম হয়েছে । বিশেষ করে যেসব উদ্যোক্তা শুধু চা বাগানের ওপর নির্ভরশীল। তারা বিকল্প বিনিয়োগ ও তারল্য অভাবে শ্রমিক মজুরি সহ শ্রমিক – সংশ্লিষ্ট পাওনা পরিশোধ করতে পারছেনা না। এসব কারণে ২০২৪ সালে দেশের চা বাগান গুলো লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে কম চা উৎপাদন করেছে । চায়ের মতো কৃষি নির্ভর খাতে নেয়া ঋণে মাত্রাতিরিক্ত সুদ , ঋণ পেতে কৃষি ব্যাংকে নানা বিড়ম্বনায় খাতের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বন্ধ করে দিচ্ছেন । সংকট নিরসনে সরকার উদ্যোগী না হলে বাগানের চা শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন । আর চা উৎপাদন কমলে কর্মসংস্থান হ্রাসের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে চা আমদানি করতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি । এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত দেউন্দি টি কোম্পানি অধীনে চা বাগান সহ সকল বাগানের প্রতি পদক্ষেপ না নিলে চা বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ।
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৬:৫১


