৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৬:৪৩

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

মানবিক পুলিশ কর্মকর্তা মোঃ রবিউল ইসলাম এর বিদায়

এসএম সুরুজ আলীঃ ফিকল-টেটার রাজ্য হিসেবে খ্যাত জেলা হবিগঞ্জ। দাঙ্গা প্রবণতা অনেকাংশে বেশী। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি, হানাহানি এবং রক্তারক্তির মত জঘণ্য খেলায় মেতে উঠে সাধারণ জনগণ। বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে তাদের এই বিরোধ। মামলা মোকাদ্দমায় জর্জরিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় অনেক পরিবারকে। কালে বিবর্তনে দাঙ্গার কালো ছায়া যখন হবিগঞ্জবাসীর ঐতিহ্যকে গ্রাস করেছে। ঠিক সেই মূহুর্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অদম্য প্রতিনিধি হয়ে হবিগঞ্জ সদর সার্কেলর দায়িত্বে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা।

পুলিশ সুপার মোঃ মোহাম্মদ উল্যাহ বিপিএম-পিপিএম এর সার্বিক নির্দেশনায় ও নেতৃত্বে অদম্য, বিচক্ষণ এবং সততার কিংবদন্তী মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা হবিগঞ্জ সদর সার্কেল যোগদান করে তাঁর আওতাধীন থানা (হবিগঞ্জ সদর মডেল, লাখাই, শায়েস্তাগঞ্জ) সমূহের সংঘটিত অপরাধ পর্যালোচনা করেন।

গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কারণ চিহ্নিত করেন। বংশ পরম্পরায় থাকা বিরোধের মূল কারণ উদঘাটনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। থানা এলাকার প্রায় প্রত্যেক গ্রামে প্রায় পাঁচ শতাধিক বিট ও কমিউনিটি পুলিশিং সভা করেন। দাঙ্গা-হাঙ্গামার কুফল সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করেন। ফিকল টেটার কাল সংস্কৃতি থেকে হবিগঞ্জবাসীকে বের করার চেষ্টা করেন।

হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষদের প্রাপ্ত সেবাটুকু প্রদানের প্রয়াসে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং খুব শ্রীঘ্রই তিনি অভিনব এক পদ্ধতি অবলম্বন করেন। মহৎ এই উদ্যোগের নাম ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ কার্যক্রম। দীর্ঘ মেয়াদী বিরোধ কিংবা ছোটখাট যেকোন ঘটনার অভিযোগপ্রাপ্ত হলে বিষয়টি মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত ঠেলে না দিয়ে অত্যন্ত মানবিক বিবেচনায় স্ব-উদ্যোগে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, কমিউনিটি-বিট পুলিশের নেতৃবৃন্দ ও সদস্যদেরকে নিয়ে বিরোধগুলো সার্কেল অফিস ও থানায় বসে প্রায় ৬ শতাধিক মামলা বিকল্প বিরোধ এর মাধ্যমে নিস্পত্তি করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে অত্র সার্কেলাধীন থানা সমূহে পূর্বের তুলনায় (হবিগঞ্জ সদর মডেল থানা-২২০, লাখাই-১২৪টি, শায়েস্তাগঞ্জ- ১০৫টি) সর্বমোট ৪৪৯টি মামলা হ্রাস পেয়েছে।

তাঁর মানবিক কর্মকান্ডে দিনে দিনে অসহায় হতদরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের ভরসাস্থলে পরিণত হয় হবিগঞ্জ সদর সার্কেল কার্যালয়। ভুক্তভোগীগণ অত্র কার্যালয়ে আসার পর মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা তাদের সকল অভিযোগ মনযোগ সহকারে শুনতেন। ভুক্তভোগীদের নিকট থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করতেন এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে অত্র কার্যালয়ে আসার জন্য নোটিশ প্রেরণ করতেন। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ ধার্য্য তারিখে উপস্থিত হলে তিনি মনযোগ সহকারে একে একে সকলের বক্তব্য শুনতেন। খুবই বিচক্ষণতার সাথে তিনি সকলের বক্তব্য পর্যালোচনা করতেন এবং বাস্তবমুখী নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন।

নিরপেক্ষতার কারণে পক্ষ-বিপক্ষদ্বয় অকপটেই সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করতেন ও তাদের মধ্যকার বিরোধ খুব সহজেই মিমাংসা হতো। অত্র সার্কেলে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রায় ছয় শতাধিক বিরোধ বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করেন। যার ফলশ্রুতিতে বংশ-গোষ্ঠীগত বিরোধ এবং দাঙ্গা হাঙ্গামা হ্রাস পায়। সাধারণ মানুষ মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নীত হয়েছে। মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন এসেছে। মানুষ বুঝতে শিখেছে, মামলা-মোকদ্দমায় অর্থ ব্যয় করা মূল্যহীন।

তিনি শুধু বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে পারদর্শী নয়, তিনি একাধারে অনেক গুণাবলি সম্পন্ন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি সৎ, বিচক্ষণ, সাহসী, দক্ষ এবং ধৈর্য্যশীল। তিনি অভিনব কৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন সূত্রহীন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করেছেন। যেসকল মামলার আসামী গ্রেফতার নয়, বরং মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সেই সকল মামলার মূল রহস্য উদঘাটন এবং আসামী গ্রেফতার করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। কর্মকালীন সময়ে তিনি প্রায় ২৫ টি সূত্রহীন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন এবং আসামী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন।

এক সময়ে হবিগঞ্জ জেলাবাসীদের এক আতংকের নাম ছিল ‘ডাকাতি’। আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্যগণ হবিগঞ্জ জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা সমূহে ডাকাতি পরিচালনা করতো। প্রায় সময় ডাকাতি সংবাদ শুনা গেলেও ডাকাতরা থাকত অন্তরালে। ফলশ্রুতি তারা তৈরী করেছিল বিভিন্ন গ্রুপ এবং দল। ডাকাত সর্দারদের নির্দেশেনা গ্রুপের অন্যান্য ডাকাতরা বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করতো। মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবার সঠিক নেতৃত্ব, সাহসি অভিযান এবং নিরলস প্রচেষ্ঠায় প্রায় ৩৯ জন ডাকাতকে গ্রেফতার এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

উলে­খযোগ্য কুখ্যাত ডাকাত কুদরত গ্রুপের ধৃত সদস্যগণের কুদরত, হানিফ, সাইদুল, ফরহাদ মিয়া, মামুন মিয়া, জিতু মিয়া প্রকাশ কবির মিয়া, মফিজুল ইসলাম, সৈয়দ আলী, খেলু মিয়া, সাজিদ মিয়া। কুখ্যাত ডাকাত সোলেমান গ্রুপের ধৃত সদস্যগণের সোলেমান, কালা বাবুল, শামিম, ইমরান। আলজার গ্রুপের ধৃত সদস্যগণের মধ্যে আলজার, আমিরুল ইসলাম, সাইফুল মিয়া, আলাউদ্দিন আলন। জালাল মিয়া, আব্বাস মিয়া, আলমগীর মিয়া।

তাঁর এরকম কর্মকান্ডে হবিগঞ্জ সার্কেলের প্রায় ৯৫ ভাগ দাঙ্গা হ্রাস পেয়েছে। জনজীবনে শান্তি ও স্বস্তি এসেছে। ফিকল টেটাল সংস্কৃতি আজকে ইতিহাস হতে বসেছে। জনসাধারণের মধ্যে দাঙ্গা, মাদক, ইভটিজিং বাল্য বিবাহ, যৌতুক, প্রযুক্তির অব্যবহার বিরোধী মনস্তত্ব তৈরী হয়েছে। এতে মামলা মোকদ্দমায় না জড়ানোয় হবিগঞ্জ সার্কেলাধীন থানাগুলোর জনগণ কোটি কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হতে রক্ষা পেয়েছে। ফলে প্রতিটি পরিবার, গ্রাম, ইউনিয়ন, সর্বোপরি সার্কেলাধীন এলাকায় শান্তিময় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবেশ বিরাজ করছে। এটি হবিগঞ্জের মানুষের দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা ছিল। যেটি তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম পেশাদারিত্ব, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, আন্তরিকতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এভাবে পুলিশ ও জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের টেকসই সেতু বিনির্মিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ অত্র সার্কেলে যোগদান করেন। চলতি বছরের ১৪ মার্চ ন্যায় নিষ্ঠ ও সততার প্রতীক মানবিক এই পুলিশ কর্মকর্তা হবিগঞ্জ জেলা হতে বদলি হলেন। তাঁর এই বিদায়ে হবিগঞ্জ বাসী অশ্রুসিক্ত। দক্ষতা, বিচক্ষণতা, সাহসিকতা, মানবিকতা এবং নিরলস কর্ম প্রচেষ্টায় হবিগঞ্জবাসীর হৃদয়ে তিনি যে জায়গা করেছেন, তা হবিগঞ্জবাসী কখনো ভুলতে পারবে না। তাঁর কীর্তি গাঁথা কর্মের কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।