১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৭:২৮

জনপ্রিয় ৫ সংবাদ

আরো কিছু সংবাদ

স্বশরীরে মেরাজ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিকঃ বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, সাইয়্যেদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন রাসুল (সা:) -এর জীবনীতে যে সকল অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল তন্মধ্যে মেরাজ অন্যতম।

মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বজগৎ ভ্রমণ, সিঁড়ি, ঊর্ধ্বরোহণ। মেরাজ আল্লাহর অসীম কুদরত। পরিভাষায় মেরাজ হলো, রাসুল (সা:) রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে এশার নামাজ শেষে উম্মে হানী (রা:)-এর গৃহে আরাম নিচ্ছিলেন। এমতাস্থায় জিবরাইল (আ:) রাসুল (সা:) কে ঘুম থেকে জাগিয়ে হারাম শরিফে নিয়ে আসেন। রাসুল (সা:) এখানে এসে হাতীমে কাবায় ঘুমিয়ে যান, জিবরাইল ও মিকাইল (আ:) পুণরায় রাসুল (সা:) -কে জাগিয়ে দেন এবং ‘জমযম’ কূপের পাশে তাকে নিয়ে আসেন। সেখানে রাসুল (সা:) বক্ষবিদারণ করে পবিত্র জমযম পানি দ্বারা তাঁর বক্ষ মোবারক ধৌত করেন। অত:পর জিবরাইল ও মিকাইল (আ:) সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ; তামাম সৃষ্টির স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসাই মেরাজ।

রাসুল (সা:) -এর ঐতিহাসিক মেরাজ আমাদের লক্ষ্য ও গন্তব্যের সন্ধান দেয়। মেরাজ স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সর্ম্পক গভীর করে তোলে। কুরআন এবং হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, যা অস্বীকার করা কুফরি।

ইরশাদ হচ্ছে- “পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছিলাম যেন আমি তাঁকে আমার নিদর্শনাবলি (কুদরতিভাবে) দেখাতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি অধিক শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।” (সুরা: বনি ইসরাইল, আয়াত- ১)।

মেরাজের একটা অংশ হলো ইসরা। হাদিসের পরিভাষায় ‘উরজুন’ শব্দ দ্বারা মেরাজের ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে। ‘ইসরা’ ধাতু থেকে ‘আসরা’ শব্দটি উৎসারিত। আভিধানিক অর্থে রাত্রে নিয়ে যাওয়া বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ। মেরাজ রাত্রের একাংশে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় ঘটনাকে ইসরা বলা হয়।

ইরশাদ হচ্ছে- “তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমালঙ্গনও করেননি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।” (সুরা: আন-নাজম, আয়াত- ১৭,১৮)।

ইবনে মালিক (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- রজবের ২৬ তারিখ রাতে হঠাৎ আমার কাছে জিবরাইল (আ:) একটি সাদা রঙের ‘বোরাক’ নিয়ে উপস্থিত হলেন। (বোরাক হচ্ছে সাদা রঙের এক প্রকার আরোহনের যন্ত্র, সে প্রতিটি কদম ফেলে দৃষ্টির শেষ সীমানায়) রাসুল (সা:)-বলেন আমি এত আরোহন করলাম, অতপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং সেখানে দুরাকাত নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমি মসজিদ থেকে বের হলাম। তখন জিবরাঈল (আ:) একটি শরাব এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তখন আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাঈল (আ:) বললেন- আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন (মুসলিম)।

মেরাজ হয়েছিল সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। এর প্রমাণ হলো কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাস। যদি আধ্যাত্মিক বা রুহানিভাবে অথবা স্বপ্নযোগে হওয়ার কথা বলা হতো, তাহলে তাদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। মেরাজের বিবরণ সুরা নাজম সুরা ইসরায় উল্লেখ্য রয়েছে।

ইরশাদ হচ্ছে- “শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথী (রাসুল (সা:) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল (আ:)। সে (জিবরাইল (আ:) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।” (সুরা: নাজম, আয়াত- ১,১৮)।

রাসুল (সা:) আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার সময় মদিনা শরিফের খেজুরবাগান এলাকায় এবং ঈসা (আ:)-এর জন্মস্থান ‘বায়তু লাহামে’ ফিলিস্তিনে উপস্থিত হন। ‘বায়তুল মোকাদ্দাসে’ পৌঁছে দুই রাকাত নামাজ তাঁর ইমামতিতে সকল নবী রাসুলগনকে নিয়ে আদায় করেন। এভাবে বিভিন্ন পয়গাম্বরদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমুহ অতিক্রম করে রসুল (সা:)-এর ভ্রমণপথে অসংখ্য আশ্চর্য ঘটনা ও কর্মকান্ড দেখে আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ঊর্ধ্বাকাশে রসুল (সা:) আদম, ঈসা, ইয়াহইয়া, ইউসুফ, ইদ্রিস, হারুন ও মূসা (আ:)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। এসময় প্রত্যেক নবীগনই রাসুল (সা:)-কে অভ্যর্থনা জানান। সপ্তম আকাশের পর রাসূল (সা:) ‘সিদরাদুল মুনতাহা’ পর্যন্ত পৌঁছেন। যখন রাসুল (সা:) ঊর্ধ্বে গমন করেন, তখন ‘লাওহে মাহফুজে’ কলম চালনার আওয়াজ শুনতে পান।

জিবরাইল (আ:) বলেন, আমার যাত্রাপথ এখানেই শেষ। এতদপো আপনার সঙ্গ দেয়ার সাধ্য আর আমার নেই। অত:পর রাসুল (সা:) আল্লাহর এত কাছে চলে যান যে, তাদের মধ্যে ধনুকের দুই মাথার ব্যবধান রইল অথবা আরও নিকটে। আল্লাহ তাঁর বন্ধুকে নিবিড় সান্নিধ্য দান করেন এবং এখানেই আল্লাহর দিদার লাভ করেন। একটি পর্দার আড়াল টেনে আল্লাহ তাঁর আত্মরূপ দর্শন করান তাঁর হাবিব রাসুল (সা:)-কে। সেখানে রাসুল (সা:)-কে আল্লাহ পাক আপ্যায়ন করান। এবং রাসুল (সা:) মহান রবের সাথে একান্ত আলাপের সৌভাগ্য লাভ করেন। তাঁর বান্দার জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উপহার নিয়ে আসেন (তথসূত্র : সিরাতে মোস্তফা)।

মেরাজ রজনীতে হাবিব ও মাহবুবের একান্ত সাক্ষাতে কয়েকটি ঘোষণা হয়েছে। আল্লাহকে ছাড়া কারও ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, নিকট স্বজনদের তাদের অধিকার দাও; মিসকিনদের ও পথসন্তানদের অধিকার দাও; অপচয় কোরো না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই, কৃপণতা কোরো না, সন্তানদের হত্যা করবে না, ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না, মানব হত্যা কোরো না, এতিমের সম্পদের কাছেও যেয়ো না, প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কোরো, মাপে পূর্ণ দাও, অবস্থান কোরো না যাতে তোমার জ্ঞান নেই, এবং পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না। এ সবই মন্দ, তোমার রবের কাছে অপছন্দ (সুরা: বনি ইসরাইল, আয়াত- ২২,৪৪)।

রজব একটি বরকতময় মাস। রজব ও শাবান মাসদ্বয়কে রাসুল (সা:) রমজানের প্রস্তুতি মাস হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন। রজব মাসকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে বেশি বেশি নফল আমল, নফল রোজা, নফল নামাজসহ অন্যান্য নেককর্মের প্রতি মনোনিবেশ করা বেশি জরুরি।

আনাস (রা:) বলেন, ‘যখন রজব মাসের আগমন হতো, তখন রাসুল (সা:) এই দোয়াটি পড়তেন, ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন’ (মুসনাদে আহমদ, নাসায়ি )।

অতএব রজব মাস থেকেই শুরু করতে হবে রমজানের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ। মহা সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে রজব মাসের মর্যাদা যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক